Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

মাছ চাষিদের ‘আইডল’ জয়নাল

মাছ চাষের পরিকল্পনা করেন ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার জয়নাল আবেদীন ১৯৯৫ সালে। সে সময়ে স্থানীয় এক মৎস্য চাষি বন্ধু তাকে মাছ চাষে উদ্বুদ্ধ করেন।

লোকসানের কথা চিন্তা করে পরিবার তাকে নিরুৎসাহিত করলেও শক্ত মনোবলে প্রথমে পাঁচটি পুকুরে পাঙাশ চাষ শুরু করেন।

বর্তমানে ৬০ একর জমিতে ২০টি পুকুর থেকে বছরে ৩ কোটি টাকার পাঙাশ মাছ বিক্রি করেন তিনি।


পরিশ্রম আর মনোবলকে কাজে লাগিয়ে বদলেছেন ভাগ্যের চাকা। কিনেছেন জমি, গড়েছেন পাঁচতলা বাড়ি। মাছ চাষে এমন সফলতা পেয়ে স্থানীয় মৎস্য চাষিদের কাছে জয়নাল এখন আইডল।

উপজেলার সদর ইউনিয়নের কোনাবাড়ী এলাকায় তার মৎস্য খামারে গিয়ে দেখা যায়, বিশাল আকৃতির একেকটি পুকুর। পুকুর পরিচর্যাসহ মাছকে খাবার দিতে ব্যস্ত কর্মচারীরা। আশপাশের বেকার যুবকসহ বিভিন্ন বয়সী মানুষ এখানে কাজের সুযোগ পেয়ে খুশি।

কথা হয় কর্মচারী মামুন মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘অভাবের সংসারে তিনবেলা ঠিকমতো পেডে ভাত দিবার পারছে না পরিবার। এর মধ্যে লেহাপড়ার ইচ্ছা থাকলেও করবার পারছি না। একটু বড় হতেই বিভিন্ন কাজকাম কইরা সংসার চালাইতাম।

‘দূরে কাজ করলে থাইক্যা খায়্যা (থেকে-খেয়ে) সব ট্যাহা (টাকা) খরচ হয়। এ জন্য কয়েক বছর আগে মৎস্য খামারের মালিককে বললে তিনি এখানে কাজ দেন। এখন যা বেতন পাই, তা দিয়েই ভালোভাবে সংসার চলে।’

মামুনের মতো এখানে কাজ পেয়েছেন শরিফ, রমজান, জহিরুল, আবদুল্লাহ, সামাদ, আইজুল, হৃদয়সহ অন্তত ২০ জন। তাদের সবাই নিয়মিত কাজ করলেও অনেকে আবার বিভিন্ন কাজ শেষে হঠাৎ মাছ ধরা, ছাড়া ও পরিচর্যার কাজ করেও টাকা আয় করেন। নিজ এলাকার মৎস্য খামারে কাজ পেয়ে তারাও খুশি।

স্থানীয়রা জানান, জয়নাল আবেদীন পুরোনো মৎস্যচাষি। অল্প সময়ে সফলতা পেয়ে জীবনের মোড় ঘুরিয়েছেন। এমন দৃষ্টান্ত দেখে নতুন করে অনেকে মাছ চাষে ঝুঁকছেন। এ ছাড়া বহু বেকার যুবক মাছ চাষ করে সফলতা পেয়েছেন। তাদের খামারেও আশপাশের লোকজন শ্রমিক হিসেবে কাজ পেয়ে বেকারত্ব ঘুচিয়েছেন।

জয়নালের খামার দেখতে যান নতুন মাছ চাষি আজহারুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘নিজের জমিতে কৃষিকাজ করেই কোনো রকমে আমার সংসার চলত। তবে চোখের সামনে ওনার (জয়নাল আবেদীন) মাছ চাষের সাফল্য দেখে অবাক হই। মনে মনে ভেবেছিলাম, তিনি সফল হলে আমি কেন পারব না?

‘তখন আমার বেশ কিছু জায়গা পতিত ছিল। সেগুলো খনন করে পুকুরে পাঙাশ চাষ করি। আমিও অবিশ্বাস্য সাফল্য পেয়েছি। নিজে সুখে আছি, আমার খামারে সাতজন কর্মচারী নিয়মিত কাজ করে তাদের সংসারও ভালো চলেছে।’

আরেক পুরোনো মাছ চাষি নজরুল ইসলাম বলেন, ‘জয়নাল আবেদীন মাছ চাষের মাত্র তিন বছরে অবিশ্বাস্য সাফল্য পেয়েছেন৷ এমন দৃশ্য দেখে আমিও ২৩ বছর যাবৎ মাছ চাষ করছি। প্রথম থেকেই লাভের মুখ দেখি৷ এতে আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়।

‘প্রথমে একটি পুকুরে পরীক্ষামূলক চাষ শুরু করি। বর্তমানে ১২ একর জায়গায় বড় ছয়টি পুকুরে মাছ চাষ করছি। এখানে নিয়মিত ১১ জন কর্মচারীর কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। আমি মাছ চাষে শতভাগ সফল হয়েছি।’

মাছ চাষে সফলতা পাওয়া জয়নাল আবেদীন  বলেন, ‘২৬ বছর হলো মাছ চাষে সম্পৃক্ত হয়েছি। লাভ না হলে এখানে টিকে থাকা সম্ভব ছিল না। তবে শুরুটা ছিল কঠিন। মনের ভেতর প্রচণ্ড সাহস আর আত্মবিশ্বাস কাজে লাগিয়ে দ্রুত সফলতা পেয়েছি।’

তিনি বলেন, ‘আমার স্থানীয় এক বন্ধু মাছ চাষ করত। বিভিন্ন বিষয়ে কথাবার্তার ফাঁকে হঠাৎ বলল, মাছ চাষে লাভ বেশি। তখন থেকেই মনে প্রবল ইচ্ছা ছিল মাছ চাষ করার। তখন বাসায় গিয়ে বাবাকে বিষয়টি বললে বাধা দেন। পরিবার তখন মনে করল আমি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পথ বেছে নিচ্ছি।

‘তবুও পরিবারকে বুঝিয়ে মাছ চাষের জন্য ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে (বিএফআরআই) গিয়ে মাছ চাষের পরামর্শ নিই। সেখান থেকে পাঙাশ মাছের পোনা সংগ্রহ করি। প্রথমে ছোট পাঁচটি পুকুরে পোনা প্রতিপালন করি। এক বছরে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি লাভ হয়েছিল। তখন সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বড় পুকুরের সংখ্যা আর মাছের পোনা ছাড়া বৃদ্ধি করি। এভাবে মাছ চাষে সফলতা পেয়েছি।’

জয়নাল আরও বলেন, ‘বেকার অনেক ছেলে আমার কাছে আসছে। তাদের সঠিক পরামর্শ দিয়ে মাছ চাষে উদ্বুদ্ধ করছি। অনেক যুবক এরই মধ্যে মাছ চাষে সফলতা পেয়েছে। এ ছাড়া যারা শুধু কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন, তারাও আমাকে দেখে পুকুর খনন করে মাছ চাষ করছেন। এতে নিজের সফলতার পাশাপাশি বেকারত্ব ঘুচছে।’

তিনি বলেন, ‘শুরু থেকেই পাঙাশ চাষ লাভজনক ছিল। এ কারণে ময়মনসিংহের অনেকেই পাঙাশ চাষে আগ্রহী হন। আগে পাঙাশের পোনা জেলার বিভিন্ন হ্যাচারিতে পাওয়া যেত। বর্তমানে বগুড়া ও সান্তাহার থেকে আনতে হয়। দুই বছর ধরে পাঙাশ দেশের বাইরে পাঠানো যাচ্ছে না। এ কারণে চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। রপ্তানি করতে পারলে ভালো দাম পাওয়া যায়।

‘এ ছাড়া তরুণদের এসএমই ঋণ দিয়ে মাছ চাষে আগ্রহী করতে সরকার উদ্যোগ নিতে পারে। এতে বেকারত্বের হার হ্রাস পাবে।’